বিদেশে পড়াশোনার কথা আমরা যখন থেকে চিন্তা করবো ঠিক তখন থেকেই চেষ্টা করবো আস্তে আস্তে সমস্ত কাগজপত্র গুছিয়ে রাখতে। সবগুলো কাগজপত্র গুছিয়ে একটি ফাইলে রাখার চেষ্টা করবো। প্রয়োজনীয় কাগজপত্র কয়েক কপি ফটোকপি আগে থেকে করে রাখবো, এতে অনেক হ্যাসেল থেকে বেঁচে যাওয়া যায়। কাগজপত্র গোছানোর সময় কোনো কাগজপত্র না থাকলে তাৎক্ষণিক তুলে ফেলার চেষ্টা করতে হবে।
কোনো কাগজপত্রে নামের বানান সহ আনুষাঙ্গিক কোনো বিষয়ে বানান ভূল থাকলে সেটি সংশোধন করে ফেলতে হবে।
বিদেশে পড়াশোনার ক্ষেত্রে বিভিন্ন ধরণের বিশ্ববিদ্যালয়গুলোতে বিভিন্ন ধরণের কাগজপত্র লাগে। তবে নিম্মে সেসকল কাগজপত্র গুলোর কথা উল্লেখ করা হলো যেগুলো বেশিরভাগ বিশ্ববিদ্যালয়গুলোতে প্রয়োজন হয়:
১. বিদেশে পড়াশোনার জন্য একটি আপডেট সিভি এবং কভার লেটার রেডি করে রাখা প্রয়োজন। অনেক বিশ্ববিদ্যালয়গুলোতে এটি প্রয়োজন হয়।
২. বিদেশে পড়াশোনার জন্য আবেদন করার সময় যে জিনিসটি সবচেয়ে বেশি প্রয়োজনীয় সেটি হচ্ছে পাসপোর্ট। যখন থেকে বিদেশে পড়াশোনার জন্য আমরা লক্ষ্য স্থির করবো ঠিক সেই মুহুর্তে পাসপোর্ট করে ফেলা উচিত। কেননা বাংলাদেশে পাসপোর্ট করতে ৩মাসের মত সময় লাগে।৫বছর এবং ১০বছর মেয়াদি পাসপোর্ট তৈরি করা যায়। ৫ বছর ও ১০ বছর মেয়াদি ই-পাসপোর্টের জন্য ফি ভিন্ন ভিন্ন হারে জমা দিতে হবে। ৫ বছর মেয়াদি ৪৮ পাতার ই-পাসপোর্ট ২ দিনে পেতে ফি দিতে হবে ৭,৫০০ টাকা। জরুরি পাসপোর্ট ৭ দিনে পেতে ফি দিতে হবে ৫,৫০০ টাকা এবং সাধারণ পাসপোর্ট ১৫ দিনে পেতে ফি দিতে হবে ৩,৫০০ টাকা। ১০ বছর মেয়াদি ৪৮ পাতার ই-পাসপোর্ট ১৫ দিনে পেতে ফি দিতে হবে ৫,০০০ টাকা। জরুরি পাসপোর্ট ৭ দিনে পেতে ফি দিতে হবে ৭,০০০ টাকা এবং অতি জরুরি পাসপোর্ট ২ দিনে পেতে ফি দিতে হবে ৯,০০০ টাকা। ৫ বছর মেয়াদি ৬৪ পাতার ‘সাধারণ পাসপোর্ট’ ১৫ দিনে পেতে ফি দিতে হবে ৫,৫০০ টাকা। জরুরি পাসপোর্ট’ ৭ দিনে পেতে ফি দিতে হবে ৭,৫০০ টাকা এবং অতি জরুরি পাসপোর্ট ২ দিনে পেতে ফি দিতে হবে ১০,৫০০ টাকা। ১০ বছর মেয়াদি ৬৪ পাতার সাধারণ পাসপোর্ট ১৫ দিনে পেতে ফি দিতে হবে ৭,০০০ টাকা। ৬৪ পাতার ‘জরুরি পাসপোর্ট’ ৭ দিনে পেতে ফি দিতে হবে ৯,০০০ টাকা। ৬৪ পাতার অতি জরুরি পাসপোর্ট ২ দিনে পেতে ফি দিতে হবে ১২,০০০ টাকা।ফি’র সঙ্গে ১৫ শতাংশ হারে ভ্যাট জমা দিতে হবে। ই-পাসপোর্টের আবেদনপত্র, জাতীয় পরিচয়পত্র বা জন্মনিবন্ধন সনদ অনুযায়ী পূরণ করতে হবে। ১৮ বছরের কম আবেদনকারী, যার জাতীয় পরিচয়পত্র নেই, তার পিতা-মাতার জাতীয় পরিচয়পত্রের নম্বর অবশ্যই উল্লেখ করতে হবে।
আর যদি পাসপোর্ট করাই থাকে তবে সেক্ষেত্রে সেটির মেয়াদ আছে কি না কিংবা কতটুকু সময়সীমা আছে সেদিকে খেয়াল রাখতে হবে। ম্যাক্সিমাম ভিসার জন্য এপ্লাই করতে হলে পাসপোর্টের মেয়াদ তিন মাসের মত থাকতে হবে। সেক্ষেত্রে পাসপোর্টের মেয়াদ বাড়িয়ে নিতে হবে।
৩. জন্ম নিবন্ধন সার্টিফিকেট এবং জাতীয় পরিচয় পত্র অবশ্যই ইংরেজিতে থাকতে হবে।
৪. সব ধরণের পরীক্ষা মানে এসএসসি, এইচএসসি, ব্যাচেলর করা থাকলে সেটি সহ সকল একাডেমিক সার্টিফিকেট, মার্কশীট এবং একাডেমিক ট্রান্সক্রিপ্ট, টেস্টটিমোনিয়াল একসাথে সংরক্ষণে রাখতে হবে। সবগুলো সার্টিফিকেট ইংরেজিতে করে রাখতে হবে।
৫. কয়েক কপি পাসপোর্ট সাইজের ছবি।
৬. SOP বা Statement of purpose লেটারটি অবশ্যই তৈরি রাখতে হবে। অনেকে এই লেটারটির কথা শুনলে ভয় পেয়ে যায়। এটি খুবই সাধারণ একটা জিনিস। আপনার নিজস্ব গল্পকেই SOP বলা হয়। আপনি কেনো এই সাবজেক্টে পড়তে চাচ্ছেন, অভিজ্ঞতা কী, গ্র্যাজুয়েশন শেষে দেশে ফিরে এসে কী করবেন, কেনো অন্য কাউকে না নিয়ে কেনো তারা আপনাকেই নিবে এ বিষয়গুলো আপনাকে উল্লেখ করতে হবে।
এই লেটারে আপনি মানুষ হিসেবে কেমন, উচ্চশিক্ষার চাপ সামলাতে আপনি কতটুকু প্রস্তুত আছেন, আপনার ব্যাকগ্রাউন্ড, প্রতিভা, অভিজ্ঞতার বিষয়ে আপনাকে উল্লেখ করতে হবে। অনেকে নিজের সম্পর্কে অনেক মিথ্যে কথা লিখে, যেটা একেবারেই উচিত নয়। নিজের বিষয়ের সত্য বিষয়গুলো সুন্দর করে লিখে দিবেন। আপনার ভবিষ্যত পরিকল্পনাটিও এখানে উল্লেখ করবেন। এটি সবসময় নিজের মত করে লেখার চেষ্টা করবেন। ইন্টারনেট থেকে কপি করা থেকে বিরত থাকবেন।
৭. আপনাকে অবশ্যই আপনার লেটার অব মোটিভেশানটি রেডি রাখতে হবে। এটিতে আপনি আপনার মোটিভেশান সম্পর্কে লিখবেন। কেনো আপনি এই বিষয়টিতে পড়তে চাচ্ছেন, আপনার ক্যারিয়ার প্লান কি, কেনো এই সেক্টরটা আপনার জন্য সুইটেবল হবে এসব আরকি। পারতপক্ষে, এই লেটার অব মোটিভেশান আপনার ক্যারিয়ারের একটা প্লান যেটা প্রমাণ করবে আপনি কতটুকু আপনার ভবিষ্যত নিয়ে আশাবাদী
৮. আপনাকে আপনার LOR বা Letter of Recommendation তৈরি করে রাখতে হবে। বিদেশে পড়াশোনার জন্য আবেদন করার সময় তিনজন ব্যাক্তিদের কাছ থেকে রিকমন্ডেশন লেটার নিতে হয়। মূলত যারা আপনাকে ভালোভাবে চেনেন, জানেন এবং আপনার কাজ সম্পর্কে অবগত আছেন তারা এই বিষয়ে আপনাকে সহায়তা করতে পারবে। এইক্ষেত্রে পরিবারের সদস্যদের বাহিরের থেকে রিকমান্ডেশন নেওয়া ভালো। এক্ষেত্রে আপনার বিশ্ববিদ্যালয়ের শিক্ষক, আপনি যদি কোনো কাজ করে থাকেন তাহলে কর্মক্ষেত্রের উর্ধ্বতন কারো থেকে লেটার সংগ্রহ করলে আপনার জন্য ভালো হবে।
৯. IELTS, TOEFL, GRE, GMAT এর সার্টিফিকেট গুলো সুন্দর করে সংরক্ষণে রাখতে হবে।
১০. আপনি যদি কোনো ধরণের পুরষ্কার জিতে থাকেন, কোনো ধরণের ইন্টারন্যাশনাল ডিবেট কিংবা চ্যাম্পিওনশীপ প্রোগ্রামে এটেন্ড করে থাকলে সেগুলোর ডকুমেন্টও খুব গুরুত্বপূর্ণ। সেগুলোকে একটি জায়গায় সংরক্ষণ করে রাখতে হবে৷ এই বিষয়গুলো আপনাকে বিশ্ববিদ্যালয়ে ভর্তির সুযোগ করার পাশাপাশি স্কলারশিপ পেতে, বিদেশে সিটিজেনশিপ পেতে সাহায্য করবে। এছাড়াও কোনো ধরণের এক্সট্রা কারিকুলাম এক্টিভিটিস, সমাজ-উন্নয়ন মূলক কর্মকান্ডের সাথে যুক্ত থাকলে সেগুলোর তথ্যও আপনার স্কলারশিপ, সিটিজেনশীপ এবং পিআর পাওয়ার জন্য গুরুত্বপূর্ণ।
১১. ছবি এবং প্রয়োজনীয় কাগজপত্রের ফটোকপি গুলোকে সত্যায়িত করে নিতে হবে। বাংলাদেশ পররাষ্ট্র মন্ত্রণালয়ের একটি বিশেষ শাখা থেকে সকল কাগজ পত্রের মূলকপি দেখানো সাপেক্ষে বিনামূল্যে সত্যায়িত করা যায়। এছাড়া নোটারি পাবলিক থেকেও সত্যায়িত করা যায়।
১২. বিদেশে পড়াশোনার ক্ষেত্রে আর্থিক সামর্থ্যের প্রমাণপত্র জমা দিতে হয়। কেউ যদি আপনি বিদেশে পড়াশোনাকালীন যাবতীয় খরচ বহন করেন তবে তার অঙ্গীকারপত্র, আর্থিক সামর্থের প্রমানস্বরূপ ব্যাংক গ্যারান্টিপত্রের সত্যায়িত ফটোকপি আপনাকে সংগ্রহ করতে হবে।
নিজ খরচে পড়ার ক্ষেত্রে আর্থিক সামর্থের প্রমানস্বরূপ স্পন্সরের নামে দেশভেদে বিভিন্ন অংকের অর্থের ব্যাংক সলভেন্সি সার্টিফিকেটের কপি আপনাকে পাঠাতে হবে। অনেক ক্ষেত্রে এ সলভেন্সি সার্টিফিকেট এর বৈধতা প্রমাণ করার জন্য বিগত ৬ মাসের ব্যাংক লেনদেন রিপোর্টের সত্যায়িত কপি পাঠাতে হয়।
এটি মূলত আপনি বিদেশে গিয়ে পড়াশোনা করবেন এবং পড়াশোনার খরচ প্রদানে আপনি সামর্থ্যবান এটি প্রমাণ করার জন্য পাঠাতে হয়।
যেকোনো বিশ্ববিদ্যালয়ে আবেদনের আগে অবশ্যই সেখানে কি কি চাওয়া হয়েছে তা ভালোভাবে পড়ে নিতে হবে। সে অনুযায়ী আবেদন করতে হবে। আবেদন করার আগে আরেকবার চেক করে দেখতে হবে সবগুলো ডকুমেন্টস ঠিকঠাক আছে কি না। কোনো ডকুমেন্টস বাদ পড়ে গেলে তা বানিয়ে নিতে হবে বা সংশ্লিষ্ট অফিস থেকে সংগ্রহ করে নিতে হবে। সবগুলো ডকুমেন্টস যেনো ইংরেজিতে করা থাকে সেদিকে লক্ষ্য রাখতে হবে। তবে এখনকার সময়ে বেশিরভাগ বোর্ড অফিস বা শিক্ষা প্রতিষ্ঠান থেকে ইংরেজিতে সার্টিফিকেট এবং মার্কশীটগুলো প্রদান করা হয়ে থাকে। যে কাগজপত্রগুলো ইংরেজিতে করা থাকবেনা সেগুলো অনুবাদ করে নিতে হবে।
অনুবাদ মূলত দুইভাবে করা যায়। বোর্ড অফিসে গিয়ে একটি নির্দিষ্ট ফরম পূরন করার পর উল্লেখিত পরিমাণ ফি ড্রাফটের মাধ্যমে জমা দিয়ে শিক্ষা বোর্ড থেকে সনদপত্র ও নাম্বারপত্রের অনুবাদ কপি তোলা যায়। তবে অনুবাদ কপি তোলার জন্য পূর্বের মূলকপি বোর্ড কর্তৃপক্ষকে জমা দিতে হবে। এটি ইংরেজি ভাষায় ডকুমেন্টস অনুবাদ করার উত্তম পদ্ধতি। তবে এই বিষয়টি সময়সাপেক্ষ বলে অনেকে নোটারী পাবলিক থেকেও কাগজপত্র অনুবাদ করে নেয়। এক্ষেত্রে পূর্বের মূলকপি এবং অনুবাদকৃত কপি একসাথে রাখতে হয়।
আপনার সমস্ত ডকুমেন্টস রেডি হয়ে গেলে আপনাকে এরপর ভর্তির জন্য আবেদন করতে হবে। ভর্তির আবেদনের বেশিরভাগ কাজই অনলাইনে হলেও অনেকক্ষেত্রে কিছু ডকুমেন্টের হার্ডকপি আপনাকে বিশ্ববিদ্যালয়ে কুরিয়ার করে পাঠাতে হবে। সেক্ষেত্রে আপনি বিশ্ববিদ্যালয়ের ঠিকানাতে কাগজপত্র কুরিয়ার করে পাঠাতে পারেন।